Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আড্ডা ও জীবনের জরুরি অংশ

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ
আনন্দ আলো: আড্ডা কি একটি প্রয়োজনীয় বিষয়?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: খুবই প্রয়োজনীয় একটা বিষয়। আমাদের জীবন কাজ দিয়ে তৈরি। কাজকে যদি আরও সৃষ্টিশীল করে তুলতে হয়, আনন্দময় করে তুলতে হয়, জীবনের বেঁচে থাকাকে যদি সুন্দর করতে হয় তাহলে কাজের পাশাপাশি আলসেমির সময়টাও দরকার। এবং এই আলসেমির মধ্যে দিয়েই মানুষের সৃজনশীল মনটা গড়ে ওঠে। যে মানুষটা সারাক্ষণ দৌড়াচ্ছে তার মাথায় কোন নতুন আইডিয়া আসবে না। কাজের মুহ‚র্তেও আমাদের মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা-ভাবনা আসে। কিন্তু যেই মাত্র সেটা একটা অলস মুহ‚র্তে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কথপোকথনের সময় আসে, তখন সেই চিন্তাগুলোই সজীবতা নিয়ে আপন পাখা মেলে। অন্তরঙ্গ মুহ‚র্তে পরস্পরের কথাবার্তা ও মনোভাবের লেনদেনের মধ্যে দিয়ে, আনন্দময় তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে, এমনকি তীব্র মতপার্থক্যের মধ্যে দিয়েও অনেক নতুন আইডিয়া আমাদের জীবনে চলে আসে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আইডিয়াগুলো এরকম আড্ডার মধ্যে দিয়েও এসেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আড্ডায় অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু তর্কে কেউ হারে না। অন্তত প্রকাশ্যে কেউ হার স্বীকার করে না। তারপরেও একটা লাভ আছে। যখন আমরা বাড়িতে ফিরি, পথে আমরা একা হই, যখন জয় পরাজয়ের আর প্রশ্ন থাকে না, তখন ঐ কথাগুলো আবার মাথায় ফিরে আসে। তখন কোথায় কোথায় আমাদের ত্রæটি আছে, সেগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আত্মপোলব্ধি পরিপূর্ণ হয়। আমাদের জীবনে এটাও আড্ডার একটা ভালো অবদান।
আনন্দ আলো: আড্ডা থেকে কোন ভাল ফলাফল উঠে আসতে হবে, এমনকি কোন কথা আছে?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: আড্ডা দিতে বসলাম এবং আমি ভাবলাম, ইহাও একটা কাজ। ইহা হইতে কিছু উঠিয়াই আসিতে হইব, তা নয়। আড্ডা একটা উদ্দেশ্যহীন, অর্থহীন, আনন্দের মুহ‚র্ত। আড্ডাকে নিশ্চিন্ত মনে নিজের খেয়ালে চলতে দিতে হবে। তাহলে সেখান থেকেই অনেক ভালো ভালো আইডিয়া উঠে আসবে। আবার যদি শুধুই আড্ডা দেওয়া হয়, সেটা ভাল নয়। যে কাজ করে না, নিস্কর্মা, তার জন্য আড্ডা খুবই ক্ষতিকর। এমনিতেই সে নিষ্ক্রিয় মানুষ, আড্ডা তাকে আরো নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আড্ডা তার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, যে জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কোন উদ্দেশ্যের সঙ্গে জড়িত আছে। তাকে আড্ডা নতুন আলোর সন্ধান দিতে পারে।
আনন্দ আলো: টিনএজাররা অধিকাংশই শিক্ষার্থী। তাদের আড্ডার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, নিÑয়ই আছে। তাদেরও আড্ডার প্রয়োজন আছে। কারণ তাদের কাজ আছে। লেখাপড়াটাই তাদের কাজ। আগেতো আমরা ভাবতাম, তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন, এখন তসবিহ জপ করবেন, আল্লাহ খোদার নাম করবেন এবং একসময় মারা যাবেন। এখনতো সেদিন আর নেই। এদেশে সবাই এখন ব্যস্ত। এখন বৃদ্ধ ব্যস্ত, যুবক ব্যস্ত, কিশোর ব্যস্ত, শিশুও ব্যস্ত। প্রতিটা মানুষ ব্যস্ত। আজ শিশুও ব্যস্ত বলে আড্ডার প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে গেছে। না হলে শিশু একটা যন্ত্রে পরিণত হবে। আড্ডা মানবিক সজীবতাকে তার মধ্যে প্রবাহিত করবে। সে একজন সুন্দর মানুষে পরিণত হবে। আমাদের ছাত্র জীবনে আমরা বিপুল আড্ডা দিয়েছি। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালদিক এবং খারাপ দিক হচ্ছে আড্ডা। আড্ডার কাছ থেকে আমি সবচেয়ে পেয়েছি এবং আড্ডা দিয়ে আমি জীবনের বিরাট একটা সময় নষ্ট করেছি।
আনন্দ আলো: এই নষ্ট করা সময়ের জন্য কি আপনার অনুশোচনা হয়?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমার মনে হয়, আমি যা কিছু করেছি এই সময় নষ্ট না করলে আমি করতে পারতাম না। গাছের তলায় ধ্যানমগ্ন হয়ে এটা করা সম্ভব হতো না।
আনন্দ আলো: আড্ডার বিষয় বলে কি কিছু আছে?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: আড্ডার বিষয় বলে কোন বিষয় নেই। আড্ডা একটা স্বতস্ফ‚র্ত ব্যাপার। ও নিজে থেকে বিষয়কে তৈরি করতে থাকে। কেউ জানে না পরের মুহ‚র্তে কি হবে। এই সৃষ্টিশীলতা আড্ডার একটা প্রাণ। আড্ডা একটা সজীব জিনিস, জীবিত জিনিস। আগের থেকে রূপরেখা নির্ধারণ করে কখনও আড্ডা হতে পারে না।
আনন্দ আলো: সৃজনশীল আড্ডা আমরা কোনটিকে বলবো?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: আড্ডা মানেই সৃজনশীলতা। যদি দেখা যায় আমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। হয়তো আয়েশী ভঙ্গিতেই দিচ্ছি, কিন্তু তার পেছনে আমার একটি চিন্তাশীল মন কাজ করছে, তবে সেটিই সৃজনশীল আড্ডা। আর শুধু পরচর্চা, পরনিন্দা, হিন্দি সিনেমা নিয়ে কথা বলা, নিম্নমানের বিষয় নিয়ে ডুবে থাকা, এ আড্ডা শেষ পর্যন্ত কোথাও নিয়ে যায় না মানুষকে। ওগুলো তারাই করে যাদের জীবনে কাজ নেই। উচ্চতর উদ্দেশ্য নেই। আড্ডা তাদের জন্যই সবচেয়ে লাভজনক, যাদের জীবনের সামনে কোন উদ্দেশ্য আছে। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর জীবনের সামনে একটা উদ্দেশ্য আছে। তাই আড্ডা তাদের জন্য লাভজনক, প্রয়োজনীয়।
আনন্দ আলো: টিএনএজ আড্ডা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তার অনেক সময় হাল্কা বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়। এ বিষয়টি সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: হাল্কা মানুষ হাল্কা বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়, সিরিয়াস মানুষ সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়। সিরিয়াস বিষয় মানে বিরক্তিকর বিষয় নয়। যে মানুষ সিরিয়াস, তার কাছে সিরিয়াস বিষয়ই সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। সুতরাং, আড্ডা একটা আনন্দের বিষয়। তবে ঐ যে বললাম, যার জীবনের উদ্দেশ্য আছে তার বিষয় কখনও হালকা হবে না। হালকা হলে বুঝতে হবে, এ মানুষ কখনই উচ্চতর জীবন চর্চার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারবে না। তখন এই আড্ডা ক্ষতিকর।
আনন্দ আলো: অতিরিক্ত আড্ডা কি ক্ষতির কারণ?
Abdullah-Abu-Syed-1আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: মাত্রাতিরিক্ত যে কোন জিনিসই ক্ষতির কারণ। জলের আরেক নাম জীবন। কিন্তু যখন আমরা নদীতে ডুবে মরি তখন ঐ জীবন খেতে খেতেই তো মরি। সুতরাং, দুনিয়াতে সবকিছুই ভাল যদি ওটা পরিমাণের মধ্যে থাকে। সীমানা লংঘনকারীকে আল্লাহ্ ভালবাসেন না। এটা পবিত্র কোরআনের মধ্যেই তো আছে। এমন কোন ধর্ম নেই, যেখানে বলা নেই যে সীমানা লংঘন কোরনা।
আনন্দ আলো: আড্ডাকে গঠনমূলক করবার জন্য কি করা যেতে পারে?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: জীবনকে অর্থপূর্ণ করা। জীবনকে অর্থপূর্ণ করলে আড্ডাও অর্থপূর্ণ হবে। গঠনমূলক হবে। জীবন অর্থহীন হলে আড্ডাও অর্থহীন হয়ে যাবে। এবং আড্ডা নিম্ন মানের ও রুচির বিষয়ে ভেসে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে এক সময় জীবনটা ও ডুবে যাবে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
আনন্দ আলো: আড্ডার সঙ্গী নির্বাচনের বিষয়ে কি কোনরূপ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: আড্ডা যত বিচিত্র মানুষের সাথে হয় ততো ভালো। কারণ ততো বিচিত্র রকমের অনুভ‚তি, চিন্তা, বাস্তবতার সাথে আমরা পরিচিত হতে পারি। আড্ডা দিতে দিতেও আমাদের জীবন প্রসারিত হতে পারে অনেক দূরে।
আনন্দ আলো: আড্ডার কি কোন সময় আছে?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: সময় থাকলে ভাল। কাজ যার আছে তার অবশ্যই একটি সময় আছে। কাজের সময়তো আর আড্ডা দিতে পারে না। ফলে আড্ডা একটা বৈকালিক বিষয়, সান্ধ্য বিষয়। পরিবারের মধ্যে হলে খাবার সময়ে কিংবা সবাই যখন একসাথে টিভি দেখছে তখন হতে পারে আড্ডা।
আনন্দ আলো: ছেলে-মেয়েদের আড্ডার ব্যাপারে অভিভাবকদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: অভিভাবকরা অনেক সময় ভয় পান কারণ আড্ডা দিতে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা কুসংসর্গে পড়ে যেতে পারে। আর আজকালতো মাদক আছে। নানান ভাবে জীবনকে অপচয় করার, অধপাতে যাবার বহু পথ খোলা আছে। কিন্তু অভিভাবক যদি নিÑিত হতে পারেন যে এখানে আড্ডা দিলে কোন ক্ষতি নেই, তাহলে তারা আর ভয় পাবেন না। তবে অভিভাবকদের উচিত তাদের ছেলে মেয়েরা কাদের সাথে মিশছে, সে বিষয়ে খবর রাখা। তাহলে ছেলে মেয়েদের বিপথগামী হবার সম্ভাবনা কম থাকে।
আনন্দ আলো: আনন্দ আলো পরিবারের পত্রিকা। পারিবারিক আড্ডার গুরুত্ব কতটুকু?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: পারিবারিক আড্ডার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দুপুর এবং রাতের খাবার ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা একসাথে খাওয়া উচিত। কারণ খেতে বসা একটা অবসরের মুহ‚ুর্ত, আলসেমির মুহ‚র্ত, আনন্দের মুহ‚র্ত। সে সময় পরস্পর পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময় করে। বাবা মা সন্তানদের কাছাকাছি আসে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সর্ম্পক তৈরি হয়। এবং এই বন্ধুত্ব তাদের জীবনকেও সুন্দর করে তোলে। এই শিশুরা বাবা মাকে বন্ধু হিসেবে পাচ্ছে। ফলে একটা সহজ পরিবেশের মধ্যে তারা বেড়ে উঠেছে। আবার বাবা মাও সন্তানকে বন্ধু হিসেবে পায়। তাদের সাথে অনেক কথা ভাগাভাগি করতে পারে। একটা সুন্দর পারিবারিক মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি হয়। যে পরিবারগুলোতে আড্ডা বেশি, সে পরিবারগুলো সুখী হয়।
আনন্দ আলো: একজন শিশু অথবা কিশোরের সবচেয়ে বড় বন্ধু কে?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: হতে পারলে বাবা-মা সবচেয়ে ভাল বন্ধু। কারণ সন্তান যদি বাবা মাকে বন্ধু হিসেবে পায় এবং বাবা মাও যদি তাকে বন্ধু হিসেবে পায়, তার চেয়ে সুন্দর পরিবার আর কি হতে পারে।