Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

অভিনয় নয় ক্যানভাসই এখন আমাকে বেশী টানে : বিপাশা হায়াত

এক নামেই যার ব্যাপক পরিচিতি। তিনি যেমন ভালো অভিনয় করেন তেমনি ভালো ছবিও আঁকেন। সম্প্রতি গুলশানস্থ বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে তারকাদের মেলা বসেছিল সেদিন। স্মৃতি উপজীব্য করে আঁকা বিপাশার এক্সক্লুসিভ এই চিত্র প্রদর্শনী দেখতে সেদিন হাজির হয়েছিলেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, অভিনেতা, পরিচালক আফজাল হোসেন, শিল্পপতি আবুল খায়ের লিটু, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল, নাট্য ব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, তৌকির আহমেদ, নাতাশা হায়াত, বিপ্লব সাহা, মীর সাব্বির সহ নগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এক ফাঁকে আনন্দ আলোর মুখোমুখি হন বিপাশা হায়াত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- সৈয়দ ইকবাল।
আনন্দ আলো: স্মৃতি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে হলো কীভাবে? বিপাশা হায়াত: এটা খুব যে একটা চিন্তা-ভাবনা করে শুরু করেছি তা কিন্তু নয়। বিষয়টা খুব স্বত:স্ফূর্তভাবে আমার ক্যানভাসে এসেছে। তবে প্রশ্ন করলে বলতে পারবো না কীভাবে এসেছে! কাজটি করার পর মনে হয়েছে- স্মৃতি ছাড়া আসলে মানুষ অর্থহীন। স্মৃতি ছাড়া মানুষ বাঁচতেও পারে না। প্রতিটি মানুষই স্মৃতি নির্ভর কাজ করেন। যিনি লেখালেখি করেন তিনি স্মৃতি নিয়েই লিখেন, যিনি ফিকশন নির্মাণ করেন, তিনিও স্মৃতি নিয়ে ভাবেন। মোটকথা, সকলেই স্মৃতি নিয়ে কাজ করেন। মানুষের স্মৃতি যে কতো ইন্টারেস্টিং হতে পারে, তা একটু ভাবলেই বোঝা যায়। স্মৃতির ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন বলা যায় আমার এই প্রদর্শনী।  আনন্দ আলো: এই যে আপনি স্মৃতির কথা বললেন, এই প্রদর্শনীতে আপনার আঁকা ছবিগুলো কোন সময়ের স্মৃতি থেকে আঁকা? বিপাশা হায়াত: প্রতিটা ছবিতে আমি একটা গল্প বলার চেষ্টা করি। ছোটবেলায় লিবিয়ায় আমার অনেক দিন কেটেছে। সেখানে  রোমান সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ দেখেছি। ওই সময়ের স্মৃতিগুলো আমার চিত্রকর্মে উঠে এসেছে। সেই ভাঙা টুকরোগুলোর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জমিয়ে ছবিগুলো আঁকার চেষ্টা করেছি। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির বিমূর্ত আবেগকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমার শিল্পকর্মে। অবচেতন মনে ছোটবেলার এটাই  ছিল আমার শক্তিশালী  স্মৃতি। আমার মেয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করে। কিন্তু ওর ছবিতে অনেক রঙ থাকে। ও হলুদের মধ্যে হলুদ রঙই বেশি করে দেয়। ছবিটাকে ও অনেক রঙিন করার চেষ্টা করে। একদিন এটাই ওর কাছে স্মৃতি হয়ে যাবে। আমার এই সিরিজটা নিয়ে তিন বছর ধরে কাজ করেছি। ২০১৪ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে এ বছরের আঁকা ছবি আর ড্রইংও আছে প্রদর্শনীতে। আমার ছবির টুকরো অংশগুলো প্রতিনিধিত্ব করে আমার টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে। আনন্দ আলো: আপনার bipashaআঁকাআঁকিতে কে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন? বিপাশা হায়াত: মাঝে মাঝে মনে হয়- আমার বাবা (অভিনেতা আবুল হায়াত) না থাকলে কখনোই আমার ছবি আঁকা হতো না। তিনিই প্রথম আমার হাতে রঙতুলি তুলে দিয়েছিলেন। তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। আর আমি যখন আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই, তখনও একমাত্র বাবাই আমার পাশে ছিলেন। তার কারণেই আসলে আমি ছবি আঁকতে পেরেছি। শুধু ছবি আঁকাই নয়। বাবার উৎসাহেই অভিনয়ে আসা। এখনো আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে বাবা খুব উৎসাহ দিয়ে থাকেন। তবে আরেকজনের কথা না বললেই নয়- তিনি আমার স্বামী তৌকীর আহমেদ। আজকের এই প্রদর্শনীটি মূলত: তার উৎসাহেরই ফল। ও শুধু আমার স্বামী নয়, ভালো বন্ধুও। ওর অনুপ্রেরণা, ভাবনা, সঙ্গ- সবকিছুই আমার জন্য বিশাল পাওয়া। এই বছরের শুরুর দিকে প্রদর্শনীটি হওয়ার কথা ছিলো। ভেন্যুও ফাইনাল করা হয়েছিল জাতীয় শিল্পকলায়। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তখন সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে হয়েছিল।  আনন্দ আলো: এখন কী তাহলে ছবি আঁকা নিয়েই সকল ব্যস্ততা? বিপাশা হায়াত: হ্যাঁ, সেটা বলা যায়। এই মুহূর্তে তো বলবো আমি সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত ছবি আঁকা নিয়েই। এজন্য অন্যান্য জায়গা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। কারণ ছবি আঁকায় আরও সময় দিতে চাই। এই স্বাধীনতাটা আসলে আমাকে অনেক আনন্দ দিচ্ছে।  আনন্দ আলো: আপনি একাধারে অভিনেত্রী, লেখক ও চিত্রশিল্পী। নিজেকে কোন পরিচয়ে বেশি এগিয়ে রাখবেন?  বিপাশা হায়াত: মা খুব চেয়েছিলেন আমি স্থপতি হই। আমার বাবা স্থপতি  তাই  মায়ের ধারণা ছিল যারা এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে তারা অনেক ভালো মানুষ হয়। তাই তিনি চাইতেন আমি এ বিষয়েই পড়াশোনা করি। আমি বুয়েটে পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। তারপর ওয়েটিং লিস্টে থাকি। আমার আগের জনও টিকে যায়, কিন্তু আমার আর ভর্তি হওয়া হয়নি। বাসায় সেদিন সবাই কান্নাকাটি করেছিল। এরপর আমি ইডেন কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। মঞ্জুরুল ইসলাম স্যার তখন ইডেনের প্রফেসর ছিলেন। আমি তিন মাস ইংরেজি সাহিত্য পড়ি। ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও আমার আগ্রহ ছিল। একপর্যায়ে আমি আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেই এবং প্রথম হই। এখনো মনে পড়ে, আম্মা তখন বলেছিলেন, ‘আমাকে আগে দেখতে হবে আর্ট কলেজের পরিবেশ কেমন? কারণ আমি শুনেছি ওখানে সবাই গাঁজা খায়। তারপর আম্মা আমার সঙ্গে আর্ট কলেজে গিয়েছিলেন। পুরো ক্যাম্পাস ঘোরার পর আম্মা তো অনেক মুগ্ধ। তারপর আম্মা আমাকে বললেন, ‘তুমি এখানেই পড়, অনেক সুন্দর জায়গা।’ মা হচ্ছেন আমাদের পরিবারের চালিকা শক্তি। আম্মা বলতেন, ‘তোমরা ভালো মানুষ হও আর যা করতে ভালোবাস সেটা কর।’ আর আমার আব্বার অনেক আগে থেকে ইচ্ছে ছিল আমি যেন পেইন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করি। আমার অনেক আগ্রহ দেখে আব্বা আগে থেকেই রাজি ছিলেন। আল­াহ্ প্রদত্ত আমি এই উপহারটা পেয়েছি তা না হলে চিত্রশিল্পী আমার পক্ষে হওয়া সম্ভব হতো না। নিজেকে মা হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালো লাগে। তবে অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। ভালো চিত্রনাট্য ছাড়া অভিনয় করছি না। এখন আঁকাআঁকি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাই। একসময় গান শিখেছি। প্রায় সাত-আট বছর গান করেছি। কিন্তু এখন সেটা করছি না।  আনন্দ আলো: ক্যানভাস আসলে আপনার কাছে কী? বিপাশা হায়াত: ক্যানভাসটা আসলে অতীত বর্তমান এবং আমার মৌলিক আবেগ ধরে রাখার জায়গা। ক্যানভাসে আমার শিল্পকর্মের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির বিমূর্ত আবেগকে তুলে আনার চেষ্টা করি। এবার ক্যানভাসে রঙ ঢেলে, রঙের আচ্চরের ওপর আঁচড় কেটে টেক্সচার তৈরি করে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি তুলে আনার চেষ্টা চালিয়েছি। সেই স্মৃতিরই নির্যাস পাওয়া যাবে আমার এসব শিল্পকর্মে। প্রতিটি ছবিতে রয়েছে আমার চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন। আছে নিজের প্রতিটি সময়, দিন, প্রতিটি মুহূর্ত। বলা যায় ক্যানভাসেই আমি নিজেকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি। আনন্দ আলো: ছবি আঁকা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ কোনো পরিকল্পনা আছে কী? বিপাশা হায়াত: একটা সময় পরিকল্পনা ছিল একদিন অভিনয় কমিয়ে দিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছবি আঁকব। আমি এখন সেই পথেই আছি। অভিনয় এখন আর আমাকে টানে না। ক্যানভাস আমাকে টানে। গৎবাধা ধরনের ছবি আমি আঁকতে চাই না। বিভিন্ন ধরনের এবং বিষয় নিয়ে আমি ছবি আঁকতে চাই। এই প্রদর্শনীর পর আমি প্রকৃতি নিয়ে কাজ করব। কারণ এখন আমাকে প্রকৃতি আকর্ষণ করছে। আমার শরীরটা ছোট হলেও মনটা অসীম। আমার মন যেখানে টানবে- সেই কাজটাই আমি করব।