Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিল!

-মিলি বিশ্বাস পিপিএম,ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ

রংপুর শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম মোয়াজ্জেম হোসেন বিশ্বাস এবং সমাজসেবী সাবেরা বিশ্বাসের কন্যা মিলি বিশ্বাস ১৯৫৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রংপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাশ করার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। অনার্স ও মাষ্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে ১৯৮৮ সালে পুলিশ ক্যাডার সার্ভিসে যোগদেন। দক্ষতা এবং যোগ্যতার সাথে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে বর্তমানে তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে ডিআইজি লজিস্টিক হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি প্রায় সাড়ে চার বছর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক (ডিআইজি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের জন্য ই-ট্রাফিক প্রসিকিউশন এর মত সম্পূর্ণ নতুন, অত্যাধুনিক ও যুগানত্মকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সফল হয়েছেন। এরও আগে তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ সুপার হিসেবে হবিগঞ্জ জেলা ও অতিঃ পুলিশ সুপার হিসেবে নেত্রকোনা জেলায় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রথম নারী সহকারী পুলিশ কমিশানার হিসেবে ট্রেনিং ডিভিশন, স্টাফ অফিসার টু কমিশনার, ট্রাফিক ডিভিশনে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি প্রথম নারী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে জাতিসংঘ শানিত্মরক্ষা মিশনে ২০০০ সালে পূর্ব তিমুরে কন্টিনজেন্ট কমান্ডার-হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের নেতৃত্ব দেন এবং বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ নারী পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। তিনি বাংলাদেশে পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক বিপিডব্লিউএন- এর প্রতিষ্টতা সহ-সভাপতি ও বর্তমান সভাপতি হিসেবে ২০১২ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে আনত্মর্জাতিক ইভেন্ট এশিয়ান রিজন ইউমেন পুলিশ কনফারেন্স সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশ এশিয়া রিজন ২২ এর কোঅর্ডিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নারী উন্নয়নে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে কার্যকরী ভূমিকা রেখে চলেছেন। সামাজিক কর্মকান্ডের অংশ হিসাবে তিনি ইউএনএআইডিএস এর উদ্যোগে বাংলাদেশ পুলিশ এন্ড ল’ এনফোরসমেন্ট এন্ড এইচ আইভি নেটওয়ার্ক এর কান্ট্রি ফোকাল পয়েন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ  মেডেল, প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল এবং ২০১৩ সালে পাক্ষিক অনন্যা শীর্ষ ১০ নারী’র একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০১৫ সালে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে কবি সুফিয়া কামাল সম্মাননা পদক লাভ করেন। ৮ মার্চ বিশ্বনারী দিবস উপলক্ষে মিলি বিশ্বাস মুখোমুখি হয়েছিলেন আনন্দ আলোর। নিচে তারই চুম্বক অংশ।

আনন্দ আলো:  ছোটবেলা থেকেই কী পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল?

মিলি বিশ্বাস: শৈশব কৈশোরে নির্দিষ্ট করে কোন চাকুরী বা পেশার ব্যাপারে স্বপ্ন ছিলো না। পড়াশোনা, খেলাধুলা আর সঙ্গীতের প্রতিই ঝোঁক ছিল বেশি।

আনন্দ আলো: পুলিশের মতো সুশৃংখল একটি বাহিনীতে যোগ দেয়ার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?

মিলি বিশ্বাস:  বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া যখন শেষ করছি সেই সময় বন্ধুবান্ধব বিশেষ করে রুমমেটদের দেখাদেখি প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেই। বাংলাদেশে তৎকালীন বাসত্মবতায় চাকুরি পাওয়া আর সোনার হরিন ধরা ছিলো একই রকম বিষয়। বাংলাদেশ পুলিশ পছন্দের তালিকায় রেখে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। যখন নির্বাচিত হই সিদ্ধানত্ম নিতে আমি দ্বিধা করিনি। যদিও এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং পেশায় অংশ নেয়া সামাজিক ভাবে সহজসাধ্য ছিলো না । কারণ পুলিশে নারী সদস্য অনত্মর্ভূক্তি ছিল সে সময় নতুন বিষয়। সমাজ ছিল দ্বিধাগ্রস্থ। সন্দেহ ছিল মেয়েরা পুলিশিং এ সফল হতে পারবে কিনা। এই দ্বিধা, সন্দেহকে অতিক্রম করার চ্যালেঞ্জ বোধ করি এবং অনুপ্রানিত হয়ে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করি। পারিবারিকভাবে কোন বাধা আসেনি। তবে কেউ কেউ যে সংশয় প্রকাশ করেনি এমন নয়। অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিল- মেয়েটা পারবে তো…?

আনন্দ আলো: একজন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নারীর সমঅধিকার সর্ম্পকে আপনার অনুভূতির কথা বলুন?

মিলি বিশ্বাস: দেখুন, নারী পুরুষের অধিকারের সাম্যতার ঘাটতি সকল সমাজে আজও এক বাসত্মবতা। পৃথিবীর সর্বত্র নারী তার অধিকার অর্জনে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। একজন নারী হিসেবে আমাকে এ বিষয়টি প্রতিনিয়ত ভাবায়। প্রানিত্মক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত ছিলো এক সময়। আজ নারীর অধিকার অর্জনের পথে নেতৃত্বের অবস্থানে আসতে পেরেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রিয় সর্ব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীর নেতৃত্ব আজ রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই সংগ্রামে সামনের সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। একারণে একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।

আনন্দ আলো: ৮মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। এই দিন সর্ম্পকে আপনার অনুভূতি কেমন?

মিলি বিশ্বাস: বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিউএন)-এ সভাপতিত্ব করার সুবাদে আনত্মর্জাতিক নারী দিবসে অনেক কর্মসূচি নিয়েছি। এই দিনটি সফলভাবে উদযাপনের অনেক প্রস্তুতি নিয়েছি আমরা।

আনন্দ আলো: ঘরে বাইরে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা এখন কেমন?

মিলি বিশ্বাস: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সাথে সাথে নারী পুরুষের সাম্যের সংগ্রাম অগ্রসর হচ্ছে প্রতিয়িত। শুধুমাত্র গৃহে নয়, সর্বত্র নারী সাহসের সঙ্গে কাজ করে পরিবেশে যে প্রতিকূলতা আছে সেগুলো দূর করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেইদিন বেশি দূরে নয় যেদিন সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারী সমান সমান অধিকার পাবে যা বাংলাদেশের মহান সংবিধানে উদ্ধৃত আছে। বর্তমানে নারী কর্মক্ষেত্রে যে সাহসের পরিচয় দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখন নারীর অধিকার শুধু দেয়া নয় তারা অধিকার আদায় করাও শিখেছে।

আনন্দ আলো: আমাদের দেশে নারীদের প্রতি সহিংসতা, হয়রানী ও নিপীড়ন হওয়ার মূল কারণ কী?

MELE-BISWAS-(33)মিলি বিশ্বাস: পরিবারে নারী পুরুষের বৈষম্য থাকলে সমাজেও তা দৃশ্যমান হতে বাধ্য। আমাদের বহুদিনের চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতি দূরীকরণ না হলে শুধুমাত্র আইন দিয়ে তা দূর করা অসম্ভব। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বৈষম্য অনেক ক্ষেত্রে নারী তার ভাগ্যের প্রাপ্তি বলে মনে করে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা আমরা বলে থাকি তার প্রয়াস কিন্তু আজ দৃশ্যমান। এক্ষেত্রে বলা যায় বর্তমানে শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নয়নে মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটেছে। সুতরাং সুন্দর ভবিষ্যত আমরা আশা করতেই পারি।

আনন্দ আলো: আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় কর্মরত নারীদের সুষ্টু সুন্দর সহনীয় পরিবেশ আছে কী?

মিলি বিশ্বাস: আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় নারী সদস্যের সংখ্যা বাংলাদেশে আট হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ না থাকলে এই ব্যাপক অংশগ্রহন সম্ভব হতো না। নারীর অংশগ্রহণ এই বিভাগে এখন কোন চমক নয়, স্বাভাবিক বাসত্মবতা। শুরুতে সবকিছুতেই সমস্যা থাকে, গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে সংশয় থাকে। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা কাটানো সম্ভব হয়। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় নারীদের জন্য সুন্দর সহনীয় পরিবেশ অবশ্যই আছে। কারণ আমি একজন নারী।

আনন্দ আলো: বিশ্বের মাপ কাঠিতে বাংলাদেশের নারীরা সমঅধিকার আদায়ে এখন কোন পর্যায়ে?

মিলি বিশ্বাস: নারীর সমান অধিকার, সামাজিক বৈষম্যের ধারা থেকে বিছিন্ন করে প্রতিষ্ঠা করা এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম। অধিকার আদায়ের এই সংগ্রামে বাংলাদেশের নারীরা বিশ্বে রোল মডেল। দক্ষিণ এশিয়ার সূচকে বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন। সেটা সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক সব দিক দিয়ে।

আনন্দ আলো: নারীর অধিকার বা সমঅধিকার প্রতিষ্টায় করনীয় কী?

মিলি বিশ্বাস: নারীকে শিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। বর্তমান সরকার গুরুত্বের সাথে তা করে চলেছে। শিক্ষা মানুষকে উপযুক্ত শক্তি যোগায়। এর কোন বিকল্প নেই।

আনন্দ আলো: আপনার নিজের পরিবার সর্ম্পকে বলুন। পরিবারে কে কে আছেন?

মিলি বিশ্বাস: আমাদের দু’টি পুত্র সনত্মান। একজন চাকরিতে, অপরজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। স্বামী অধ্যাপনা করতেন। বর্তমানে কৃষিতে পূর্ণপ্রাণ নিবেদিত।

আনন্দ আলো: আপনার কাছে বিনোদন কী। অবসরে কী করতে ভালোবাসেন গান শুনতে না নাটক, সিনেমা দেখতে?

মিলি বিশ্বাস: অবসর খুবই কম, নেই বললেই চলে। কর্মই ধর্ম, বলতে পারেন। কাজের সূত্রে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে-ভ্রমণটাও হয়ে যায়। সরকারী কাজে টুকটাক বিদেশেও  যাই। গান শুনতে ভালোবাসি।

আনন্দ আলো: শেষ কবে কোন বইটি পড়েছেন?

মিলি বিশ্বাস: আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী। বারবার পড়ি।