Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

অগ্রগতির মহানায়ক

রাজু আলীম: এতো পথ চলার পর, এত কিছু করার পরও, এখনো কিছুই করতে পারিনি, মনে করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। এখানেই তাঁর মহত্ব এখানেই তাঁর বিশেষত্ব। এখনো স্বপ্ন দেখেন, আক্ষেপ আরও অনেক বেশি কিছু করতে না পারার দু:খ তাঁর জীবনে- এই দর্শনের জন্যেই তিনি অনন্য। ওয়াইজ পার্সনস থিঙ্ক এ্যালাইক- পৃথিবীর সব জ্ঞানীরাই এক রকমের চিনৱা করেন। জ্ঞানীদের সেই মহাত্বের ধ্বনী, তুচ্ছ আমি অতি তুচ্ছ, ক্ষুদ্র আমি নগন্য, অনু হতে নগন্যও, জানি আমি অতি হেয়, ক্ষুদ্র আমি অতি ছোট। স্যার ফজলে হাসান আবেদের কণ্ঠেও সেই মহাকালের একই সুর—‘বিশ্বাস করুন ভাই, আমি কিছুই না। আমি কিছুই করতে পারিনি। এই মহাকালের মহাজ্ঞানের স্রোতে বলতে পারেন আমি কে? আমি কিছুই না নাথিং। মহামানবের লাখো কোটি  অমরতার মিছিলে আমি কেউ না। আমি তুচ্ছ, আমি যতো চিনৱা করেছি- স্বপ্ন দেখেছি- যত ভেবেছি যতো করতে চেয়েছি তার বেশিরভাগই করতে পারিনি। আপনারা কেন আমার ইন্টারভিউ করেন বলতে পারেন?- হু আই অ্যাম?’ নিজেকে ছোট ক্ষুদ্র ভাবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ফজলে হাসান আবেদের অসাধারণরত্ব।

Fazle-hasan-Abed-2মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারের ১০ তলায় এক্সিকিউটিভ ফ্লোর। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদসহ সর্বোচ্চ পদের কর্মকর্তারা বসেন এই তলায়। টপ ফ্লোর থেকে নীচের সিকিউরিটি সবার কাছেই তিনি আবেদ ভাই। ছোট বড় সবাই তাকে ডাকেন আবেদ ভাই। স্যার সম্বোধন পছন্দ করেন না ফজলে হাসান আবেদ। যে সম্বোধন তিনি পছন্দ করেন না। সেই ‘স্যার’ উপাধি তার নামের পূর্বে জুড়ে দিয়েছে  পৃথিবীর মানুষ। বিশ্ববাসীর এই ভালবাসা তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। তাই এখন তিনি বিশ্ববাসীর ‘স্যার’। বাংলাদেশের গর্বিত সনৱান আমাদের সবার প্রিয় আবেদ ভাই। দারিদ্র বিমোচন এবং দারিদ্রের ক্ষমতায়নে বিশেষ ভুমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ  ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইটহুড’ উপাধি প্রদান করে। এই উপাধির বিশেষ দিক হলো খেতাবপ্রাপ্তদের নামের আগে ‘স্যার’ উপাধি ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বদের পাশে নিজের কাজ দিয়ে স্থান করে নিলেন ফজলে হাসান আবেদ।

Fazle-hasan-Abed-3এক অগ্রগামী কর্মযোগী মানুষ ফজলে হাসান আবেদ। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ওই এলাকার একজন ধর্ণাঢ্য ভুস্বামী। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওই এলাকার বড় জমিদার। তার পরিবারের সবাই শিক্ষিত ছিলেন। দাদারা ছিলেন চার ভাই। সকলেই কলকাতা গিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ফজলে হাসান আবেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যনৱ লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তার বাবা দেশভাগের ঠিক আগে পক্ষাঘাতে আক্রানৱ হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি চাচার চাকরিস্থলে ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যনৱ সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সাথে পাবনায় চলে আসেন এবং পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাশ করেন ঢাকা কলেজ থেকে। সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। নেভাল আর্কিটকচারের কোর্স ছিল চার বছরের। দু’বছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গ্লাসগো ইউনিভর্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। এখানে  কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের উপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স সমাপ্ত করেন ১৯৬২ সালে। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডায় কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব ল’ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব এডুকেশন’ ডিগ্রি লাভ করেন।

চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াকালীন সময়ে ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানেও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে চলে যান আমেরিকা। ১৯৬৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে তিনি  শেল অয়েল কোম্পানীর  হেড অব ফাইন্যান্স পদে যোগদান করেন। এখানে চাকরির সময়ে ’৭০ এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। এ সময় তিনি তার বন্ধুদের নিয়ে ‘হেল্প’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। উপদ্রুত এলাকা মনপুরায় গিয়ে ত্রাণকার্য পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ফজলে হাসান আবেদ প্রকৃত অর্থেই  একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু কোনদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেন না। সেই পরিচয় ভাঙিয়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহিরও করেননি কোনদিন। এই খানেই ফজলে হাসান আবেদের মাহাত্ম, এটাই তার স্বকীয়তা। একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে ফজলে হাসান আবেদ সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বসৱ বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি তার লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে ত্রাণকাজ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসসৱুপে পরিণত হওয়া  সুনামগঞ্জের প্রত্যনৱ অঞ্চল শাল্লা এলাকায় কাজ শুরু করেন।  এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় তিনি ব্র্যাক গড়ে তোলেন। অসহায় সুবিধা বঞ্চিত যুদ্ধবিধ্বসৱ দেশকে পুন:গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। মানুষ যাতে দক্ষ হয়ে উঠে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ে তুলতে পারে সে জন্যে দীর্ঘমেয়াদী সব পরিকল্পনা হাতে নেন ফজলে হাসান আবেদ। চার দশকের মধ্যে তিনি তার অভূতপূর্ব নেতৃত্বের মাধ্যম কর্মকান্ডের বিসৱার ঘটান। ব্র্যাক পরিণত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।

Fazle-hasan-Abed-4ফজলে হাসান আবেদ পারতেন, বিদেশে বসে আরাম আয়েশে বড় চাকরি করে নিজের জীবন সুখ স্বাচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি তা করেননি, উল্টো ইংল্যান্ডের সম্পদ বিক্রি করে যুদ্ধবিদ্ধসৱ বাংলাদেশের পুন:গঠনে আত্মনিয়োগ করেছেন। কারণ তিনি ভোগবাদী সমাজের প্রতিনিধি নন। তিনি ত্যাগ করেছেন তার সম্পদ, জীবন, যৌবন, কর্ম সবকিছুকেই দেশের কল্যানে। মানুষের জন্যে- এখানেই ফজলে হাসান আবেদের বড় হয়ে ওঠার কৃতিত্ব। তিনি আর দশ জন বাঙালির মতো শুধু নিজের সুখের কথা চিনৱা করেননি, তিনি একা ভাল থাকতে পারতেন কিন্তু সেটা তিনি করেননি। তিনি চেয়েছেন সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে। দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্যে নিজের সবকিছু উজাড় করে দেয়ার মধ্যেই ফজলে হাসান আবেদের অনন্যতা। তিনি সাধারণ মানুষ নন। মহাপুরুষের মতো বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন। ত্যাগী  আর নিবেদিতপ্রাণ সমাজ সংস্কারক ফজলে হাসান আবেদ। সমাজের উন্নয়নে কি করেননি তিনি? এই দেশের গুণীজনদের দিতে চেয়েছেন তার উন্নয়নের ভাগ। তাইতো বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুল রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন’ এদেরকে নিয়ে ব্র্যাকের যাত্রা শুরু করেন। ফজলে হাসান আবেদ হন নির্বাহী পরিচালক। কবি সুফিয়া কামাল’কে করেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। এখানেও ফজলে হাসান আবেদের উদার মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান হতে পারতেন। কিন্তু তিনি কবি সুফিয়া কামালের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে প্রথম চেয়ারম্যান করে নিজে তার অধীনে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এটাই ফজলে হাসান আবেদের উদারচেতা মনোভাব এবং উদার ও প্রশসৱদৃষ্টির অনুপম নজির। তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে একে একে সম্প্রসারিত হতে থাকে ব্র্যাক। চালু করেন ব্র্যাকের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম, কারুশিল্পী পণ্য বিতরণ কেন্দ্র ‘আড়ং’, অতিদরিদ্রদের জন্যে কর্মসূচী (সিএফপিআর-টিইউআর), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ব্য্রাক ব্যাংক, বিকাশ, ব্র্যাক ডেইরীসহ অসংখ্য সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিশ্বের ২০টির বেশি দেশে ব্যা্রকের লক্ষ লক্ষ কর্মী কোটি কোটি মানুষের জীবনের মান  উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। ফজলে হাসান আবেদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব অজস্র প্রতিকূলতাকে জয় করে ব্র্যাকের এই অনন্য সাধারণ অর্জনকে সম্ভব করে তোলে। তার কাজের স্বীকৃতি আসে দেশ বিদেশ থেকে। বিশ্বজনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান এবং বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে ফজলে হাসান আবেদ ২০১৬ সালে ‘টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল হেলথ’ পদক লাভ করেন। খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৫ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি হাঙ্গেরির ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি’(সিইইউ) থেকে ‘ওপেন সোসাইটি প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১১ সালে তিনি কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ওয়াইজ পুরস্কার’ লাভ করেন। ২০১০ সালে দারিদ্র বিমোচনে যুক্তরাজ্যের অন্যতম সম্মানজনক উপাধি ‘নাইটহুড’ লাভ করেন। এছাড়া ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৮), ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৭), হেনরি আর ক্রাভিস প্রাইজ ইন লিডারশিপ (২০০৭), দারিদ্র দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্যে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) প্রদত্ত আজীবন সম্মাননা (২০০৭), গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ (২০০৪), গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩), দ্যা শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০২), ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড (২০০১), ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ড (১৯৯২), অ্যালানশন  ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার (১৯৯০), ইউনেসকো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫) এবং ম্যাগসাইসাস অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিটি লিডারশিপ (১৯৮০) লাভ করেন। অশোকা ফজলে হাসান আবেদকে অন্যতম ‘ গ্লোবাল গ্রেট’ স্বীকৃতিতে ভুষিত করছে। ২০১০ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ‘স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ’র একজন হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। বাংলাদেশের গর্ব ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি (২০১৪), যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি (২০১২),  যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (২০১০), যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লেটার্স (২০০৯), যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (২০০৮), যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অব হিউম্যান লেটার্স (২০০৭), যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর ইন এডুকেশন (২০০৩), কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (১৯৯৪) উল্লেখযোগ্য।

Fazle-hasan-Abed-1সম্প্রতি ফজলে হাসান আবেদের ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ সংবর্ধনা গ্রন্থ’ বের হয়েছে। গ্রন্থটির সম্পাদনায় ছিলেন ফারুক চৌধুরী। সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন আসিফ সালেহ, সুবল কুমার বণিক, সাজেদুর রহমান, ইকরামুল কবীর। বাংলাদেশের আরেক গর্ব বিশ্বজয়ী বাঙালি নোবেল লরিয়েট ড. মুহম্মদ ইউনূস  ফজলে হাসান আবেদকে ‘বিশ্বগুরু আখ্যা দিয়ে এই বইয়ে লেখেন, ‘সামাজিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় ফজলে হাসান আবেদ নি:সন্দেহে বিশ্বগুরু। আমরা জাতি হিসেবে সৌভাগ্যবান যে, তিনি এদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। এমন সময়ে তিনি বাংলাদেশে জন্মেছেন যখন তার প্রয়োজন ছিল।’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘১৯৫৭ সালের শরৎকালে আমি সর্বপ্রথম বিলেতে যাই। সেখানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় মাস অবস্থান করি এবং ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে লন্ডন ত্যাগ করি। অক্সফোর্ডে আমাদের তিনটি শিক্ষা টার্মে পড়াশোনা করতে হয়। টার্ম শেষে আমরা লন্ডনে বেশ কিছুদিন কাটালাম। লন্ডনে তখন পাকিসৱানি হাই কমিশনের একটি অতিথি ভবন ছিল যেখানে স্বল্প খরচে থাকা যেত। এই লন্ডনে ১৯৫৭ সালের শীতকালে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তার পুরো নামটি হলো সৈয়দ ফজলে হাসান আবেদ এবং ব্র্যাকে তিনি সবার কাছে আবেদ ভাই নামে পরিচিত।’  ‘বন্ধু আমার’ নামে লেখায় শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘ এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্র্যাক সক্রিয়, উত্তর আমেরিকাতেও তার উপস্থিতি রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এটি। কী করে তা সম্ভবপর হলো? একজন মানুষের একাগ্রচিত্ততার ফলে তো বটেই, ঠিক মানুষকে ঠিক জায়গায় বসানোর ব্যাপারে আবেদের যে দক্ষতা তাও এই সিদ্ধির একটা কারণ। ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আড়ং’ কী বিশাল কর্মযজ্ঞ গড়ে তুলেছে! অনেকে বলেন, আবেদের সাম্রাজ্য ক্রমেই বিসৱৃত হচ্ছে। আবেদ যে সারা বিশ্ব থেকে ঈর্ষণীয় সম্মান লাভ করে চলেছে, সে তো এমনি নয়! ব্র্যাক বহু নারী পুরুষকে তার ভাগ্যের পরিবতর্ন ঘটাতে, বহু কিশোরকে অপ্রত্যাশিত শিক্ষা লাভ করতে সাহায্য করেছে।’ ফারুক চৌধুরী লিখেছেন, ‘উন্নয়ন কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে মধ্যম ও উন্নত দেশের সারিতে অবস্থান করে নেবে। তখন এ কাজের কান্ডারি হিসেবে বর্তমান কর্মক্ষেত্রগুলোতে ব্র্যাকের অবস্থান করার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ব্র্যাক সর্বাবস্থায়ই ভিন্নতর প্রয়োজনে নবনব ক্ষেত্রে তার উপস্থিতি ঘোষণা করবে। সেই নতুন বাংলাদেশে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান সমধর্মী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নবতর ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। আর এর মধ্য দিয়েই পরিস্ফুট হয়ে উঠবে, কী অসাধারণ দূরদৃষ্টি  এবং বাসৱবধর্মী চিনৱার প্রেক্ষাপট থেকে ফজলে হাসান আবেদ তাঁর কাজের ক্ষেত্র নির্ধারণ করছিলেন।’ ফজলে হাসান আবেদকে মেন্টর বা গুরু আখ্যা দিয়ে আবুল খায়ের লিটু লেখেন, ‘আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে যখন আমার খালাত বোন শিলু আপা তার জীবনসঙ্গি হলেন। শিলু আপা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি একদিন পরিচয় করিয়ে দিলেন আবেদ ভাইয়ের সাথে। তাদের দুজনের সঙ্গেই নানা বিষয়ে গল্প, আলাপ আলোচনা হতো আর এভাবেই একটু একটু করে আমি আবেদ ভাইয়ের ঘনিষ্ট হয়ে উঠি। আবেদ ভাই মিতভাষী। তাকে দেখলে বোঝার উপায় নেই এই মানুষটি এতো বিচক্ষণ এবং স্বপ্রদ্রষ্টা। ‘বিরল ব্যক্তিত্বের সরল গুণগান’ নামে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর লিখেছেন, ‘আনৱর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান এই মানুষটির উপাধি এখন সকলের কাছে ‘স্যার’। সেই স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে যখন কথা বলি, তখন উপলব্ধিতে আসে একজন মাটির মানুষের সঙ্গে কথা বলছি। তিনি জানেন আমার খবর। আমার মায়ের খবর। আমার সনৱানদের খবর। এমন মানুষই আমাদের দেশে, সমাজে অনেক বেশি প্রয়োজন। গণমাধ্যম ও কৃষি উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ লিখেছেন, ‘ ফজলে হাসান আবেদ তাঁর সুদীর্ঘ কর্মবহুল জীবনে এদেশের জন্যে অনেক বড় সম্মান বয়ে এনেছেন। ব্রিটিশ সরকারের নাইটহুড, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ, গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কারসহ অনেক বড় বড় পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি পেয়েছেন। তার হাতে গড়া সংগঠন ‘ব্র্যাক’ পৃথিবীর বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের মর্যাদা নিয়ে ব্যাপক উদ্যমে কাজ করে চলেছে। সব মিলিয়ে তার বিরামহীন কর্মসাধনা এদেশের জন্যে আরও বড় মর্যাদা ও সম্মান বয়ে আনবে এই বিশ্বাস করি।’

পরিশেষে বলা যায়- স্যার ফজলে হাসান আবেদের কর্মজীবন এবং দর্শন নিয়ে চর্চা করলে একটি সত্য খুব সহজেই অনুমেয় হয়, ‘তিনিই বাঙালির বিশ্বনায়ক, অগ্রগতির মহানায়ক……’।